নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা
ঢাকা: কাগজে-কলমে দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। ২০৪১ সালে অর্থাৎ আগামী ১৯ বছরে এই সক্ষমতা ৬২ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যেতে চায় সরকার। যা ‘রূপকল্প ২০৪১’-এ উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম ধরা হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে। এই সোর্স থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। আর মোট চাহিদার অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ পরমাণু সোর্স থেকে যোগ করার কথা। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রস্তুত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে মহাপরিকল্পনা। যা আগামী ডিসেম্বরেই চূড়ান্ত হতে পারে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি চূড়ান্ত হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত একটি সুপরিকল্পিত কাঠামো নিয়ে এগোবে।
পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানকে (পিএসএমপি) বিদ্যুৎ খাতের দলিলও বলা চলে। দেশের বিদ্যুৎখাতের ভবিষ্যত রূপরেখা রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। বর্তমান সরকার দ্বায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারই আলোকে কয়লা থেকে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে ২০১০ সালে তৈরি করা হয় এই মহাপরিকল্পনা। এই ৫০ শতাংশের ৩০ শতাংশ স্থানীয় আর ২০ শতাংশ ছিল আমদানি নির্ভর। আর আমদানি করা এলএনজিসহ গ্যাস থেকে ২৫ শতাংশ, তরল জ্বালানি থেকে ৫ শতাংশ। বাস্তবে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ফলে ২০১৬ সালে এসে ওই মহাপরিকল্পনা সংশোধন করা হয়। সেখানে কয়লা থেকে ৫০ শতাংশ বাদ দিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়। যার প্রায় পুরোটাই রাখা হয় আমদানিনির্ভর।,অন্যদিকে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩৫ শতাংশ। আর বাকি ৩০ শতাংশ রাখা হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। যে কয়লা ও গ্যাসের ওপর নির্ভর করে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি। দেশীয় উৎসে গ্যাস, কয়লার মজুত কমে আসার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি পাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল জমি সংকট। সব মিলিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়নি। যে কারণে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যান ধরেই প্রস্তুত করা হচ্ছে ২০২১ সালে উদ্যোগ নেওয়া মাস্টারপ্ল্যান।,
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী মাসে আবারও একটা বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। জাইকা তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনাই হবে মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। আর এবার বিদ্যুতের পাশাপাশি মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হচ্ছে জ্বালানি খাত। এদিকে, পাওয়ার সেল সূত্রে জানা গেছে, দেশের বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তেলের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুত হবে এবারের মাস্টারপ্ল্যান।,
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা নেওয়া হবে। এতে উৎপাদনে থাকবে দুই ধাপ। যেমন- আগের ধাপে থাকবে উৎপাদনে জ্বালানির উৎস, আর পরের ধাপে থাকবে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা।’ তিনি বলেন, ‘আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি জাইকার সঙ্গে আমাদের বৈঠক রয়েছে। সেখানে আমরা ফাইনালি আলোচনা করব। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে এটি চূড়ান্ত করে ফেলতে পারব বলে আশা করা যায়।’
নতুন মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে। সাসটেইনেবল রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-স্রেডার তথ্য মতে, বর্তমানে গ্যাস, কয়লার বাইরেও সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ, বায়োম্যাস, বায়োগ্যাস থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে সেসব উৎস থেকে পাওয়া বিদ্যুতের পরিমাণ একেবারেই কম। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা ৯০৯ দশমিক ১৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌর থেকে ৬৭৫ দশমিক ২ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট, বায়োম্যাস থেকে দশমিক ৪ মেগাওয়াট।,
২০০৮ সালে নবায়নযোগ্য নীতিমালা ঘোষণা করে সরকার। ওই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। কিন্তু এ পরিকল্পনার র্দীঘ সময় কেটে গেলেও সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি অর্জিত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুর্নিদিষ্ট পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল, প্রযুক্তির অনভিজ্ঞতা এবং সৌরশক্তির ব্যবহারে প্রয়োজনীয় জমির সংকটই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘জমির কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে এগানো যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশ অনেকগুলোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিছুর কাজ এগিয়ে চলছে। এগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে, রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী, আগামী ১৯ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতিবছর গড়ে ৩১০০ মেগাওয়াট বাড়ানোর মাধ্যমে ৬২ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এর কৌশলে পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্তত ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ উৎস থেকে উৎপাদনের কথা রয়েছে। পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরমাণু শক্তির উৎস থেকেও।,
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান জানিয়েছেন, বিদ্যুতের মোট চাহিদার ১০ শতাংশ আসবে নিউক্লিয়ার থেকে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ৬৬তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের একথা জানান তিনি। সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, ওই সম্মেলনে অনেক দেশের মন্ত্রীরা জানিয়েছেন যে, তারাও তাদের দেশের মোট চাহিদার ১০ শতাংশ নিউক্লিয়ার থেকে পেতে চান।,
ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আমরা তো শুরু করে দিয়েছে। আমরাও ১০ শতাংশ পাবো এই মাধ্যম থেকে। তবে সেজন্য আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের বিশেষজ্ঞ নেই। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে একটা বড় অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে।’ এসব বিষয়ে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘বিস্তারিত দেশে ফিরে জানাবেন।’
এদিকে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকার দেশের সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখেছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর দাবি উঠেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’র ডাকে সারাবিশ্বে জলবায়ু ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত ওই কর্মসূচিতে গ্যাসের আমদানি কমিয়ে দেশীয় উৎস সন্ধানে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের যে মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত হচ্ছে সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ বাড়ানোরও সুপারিশ করেছেন তারা।,
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবাষির্কীকে সামনে রেখে দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সে লক্ষ্য অনুযায়ী চলতি বছরে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লাখ।,
from Sarabangla https://ift.tt/iMSZtVh