‘মনের পশুরে কর জবাই; পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই’

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত এক ইবাদতের নাম কোরবানি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- 'আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি (সূরা হাজ্ব; আয়াত-৩৪)।' এরপর অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, 'অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করল এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন জবেহ করার জন্য। 
আমি তাকে (ইসমাইল) মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। (সুরা সাফফাত আয়াত-১০৩ ও ১০৭)' পিতা-পুত্রের সেই আত্মত্যাগ দয়াময় প্রভুর দরবারে এতটাই প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সব উম্মতের মধ্যে তা স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখলেন। কুরআনে বলা হয়েছে- আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে ইব্রাহিমের এই সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সুরা সাফ্ফাত আয়াত-১০৮)।' কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে, মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করা। কবি নজরুল বলেছেন- মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই। কিন্তু এ কাজটিও করেন কজন! সবাই তো পশু জবাইয়ে ব্যস্ত।, 

এতে কোরবানির যে মূল উদ্দেশ্য তা থেকে সরে যাচ্ছি আমরা। মহিমান্বিত এই ইবাদতটি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম শর্তই হচ্ছে তাকওয়া বা একনিষ্ঠতা। যার বর্ণনা পবিত্র কালামে ইলাহিতে এভাবে এসেছে- 'আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন তা হচ্ছে এই যে, যখন তারা দুজনে কোরবানি পেশ করল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হল অন্যজনের কোরবানি কবুল হল না। তখন সে তার ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকিনদের কোরবানিই কবুল করেন (সূরা মায়িদা আয়াত-২৭ ও ২৮)।' কোরবানি গ্রহণ হওয়ার মূল উপাদান তাকওয়া বা খোদাভিরুতা। ,

ইরশাদ করেছেন- আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত কোনো কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া (সূরা হজ আয়াত-৩৭)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবন কাছির তার গ্রন্থে একটি সহিহ হাদিসের বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন, 'আল্লাহতায়ালা তোমাদের দৈহিক রূপের দিকে দেখেন না এবং তোমাদের দিকেও তাকান না বরং দৃষ্টি থাকে তোমাদের অন্তরের ওপর ও আমলের ওপর।' আমাদের সমাজে অনেকেই এমন আছেন, যারা মোটা তাজা পশু কেনেন লোক দেখানোর জন্য। বুক ফুলিয়ে, গর্ব করে, সেই কোরবানির পশুর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে থাকেন পুলকিত মনে। এমনকি অনেকে তো মেসি, রোনালদো, নেইমার, রাজাবাবু, সম্রাট ইত্যাদি নামের মোটা-তাজা গরু কেনাকে নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম বলে মনে করেন। ,

এ ধরনের ছোট একটি মনোভাবই কোরবানি বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাদের এই কোরবানি যে, ইবাদত নয় তা বলাই বাহুল্য। ইরশাদ হচ্ছে, 'যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে (সুরা কাহফ-১১০)।' ‘গরুটা কিন্যা জিতছি বা গরুটা কিন্যা ঠকছি। গরুর দাম এত, মাংস হয়েছে এত কেজি। বড় গরু কোরবানি না দিলে ইজ্জত বাঁচবে না। সমাজে কতক কোরবানিদাতা রয়েছেন, যারা খোশগল্পের ছলে এ জাতীয় কথা অহরহ বলে থাকেন। এ ধরনের অহেতুক কথা কোরবানির যথাযথ উদ্দেশ্যকে নষ্ট করে। কেননা কোরবানি আল্লাহর জন্য। যা লাভ-ক্ষতি, হিসাব-নিকাশ সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ঈদের দিন গরিব-দুঃখী মানুষ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে সামান্য একটু গোশতের জন্য।,

 পশুর চামড়া বা চামড়া বিক্রির সামান্য টাকার জন্য। এ ক্ষেত্রে অনেক কোরবানিদাতাকে দেখা যায়, তাদের সঙ্গে রুক্ষ আচরণ করে। কেউ কেউ আবার তাদের রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের গর্হিত কাজ প্রভুর দরবারে কোরবানির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। ইরশাদ হচ্ছে, এবং প্রার্থীকে ধমক দিবেন না (সূরা আদ্ দুহা-১০)। কোরবানির মাংস ও চামড়া বিক্রির অর্থ বিতরণে ইসলামের মূল আর্দশ হচ্ছে কোরবানিদাতা তার মাংস ও অর্থ গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। কিছু কোরবানিদাতা এমন রয়েছেন, যারা হাসিলের টাকা এড়ানোর জন্য বিভিন্ন কুটকৌশলের আশ্রয় নেন। হাটে পড়শির গরু কিনে, না কিনার ভান করে বাড়ি এসে টাকা পরিশোধ করেন। তাদের এ ধরনের কুটকৌশলে কোরবানি নষ্ট হয়ে যায়।,

 কোরবানির প্রতিটি পর্বে চাই তাকওয়ারপূর্ণ প্রতিফলন। পশু কেনা থেকে জবাই করা ও চামড়া বিক্রি করা পশুর বর্জ অপসারণ তারই কর্তব্য। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করা প্রভুর পক্ষ থেকে গরিব দুঃখীর আমানত। যার যথাযথ প্রাপ্তি নিশ্চিত, সংরক্ষণ ও প্রকৃত হকদারের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রত্যেক কোরবানিদাতার একান্ত কর্তব্য। ইরশাদ হচ্ছে- আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার প্রকৃত হকদারের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে। (সূরা নিসা-৫৮)। সমাজের কিছু বিত্তশালী, পেশিশক্তির মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা ঈদুল আজহা এলেই নিজেদের হীনস্বার্থে সিন্ডিকেট তৈরি করে চামড়ার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। স্বল্পমূল্যে ক্রয় তিনগুণ মূল্যে বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভারী করেন।,

এটি অসহায়দের হক নষ্টের অন্যতম কারণ। ইরশাদ হচ্ছে- কেয়ামত দিবসে প্রত্যেক হকদারের হক আদায় করে দেয়া হবে, এমনকি শিংবিশিষ্ট ছাগল শিংবিহীন ছাগলকে মেরে থাকলে ওর প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়ে দেয়া হবে। (আল মুসলিম) অনেক কোরবানিদাতা রয়েছেন, যারা পশুর বর্জ্য ঠিকভাবে পরিষ্কার করেন না। এ কারণে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, ফলে পরিবেশ দূষণের মতো ইসলামের আর্দশবর্জিত এ কাজ হয়। কষ্ট পায় মানুষ। মালিক অখুশি হন। ইরশাদ হচ্ছে- প্রকৃত মুসলিম তো ওই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ তথা কর্ম ও কথায় অপর মুসলমান কষ্ট পায় না। (তিরমিজি ও সুনানে নাসায়ী) আল্লাহ আমাদের কোরবানি বিষয়ে কাজগুলো তাকওয়া ও একনিষ্ঠভাবে করার তৌফিক দান করুন।,

 লেখক: তরিকুর রহমান appeared first on Sarabangla http://dlvr.it/STdzq8
এই পোস্টটি শেয়ার করুন
সবার আগে কমেন্ট করুন
কমেন্ট করতে ক্লিক করুন
comment url
আজকের সেরা খবর গতকালের সেরা খবর

এডিটর নির্বাচিত ভিডিও